Brokers Reviled New Techniques for Human Trafficking

Brokers Reviled New Techniques for Human Trafficking

মানবপাচার : প্রতারকচক্রের ফাঁদে নানা দুর্ভোগ

সিরাজুল ইসলামের বাড়ি মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার বনগ্রামে। পরিবারের সচ্ছলতার আশায় তাঁকে বিদেশে পাঠানো হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রামের ইতালিপ্রবাসী এক ব্যক্তি তাঁকে এ ব্যবস্থা করে দেন। জমি বিক্রি করে এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে টাকা জোগাড় করেন সিরাজুল। দালালের হাতে তুলে দেন ১২ লাখ টাকা। বৈধ পাসপোর্ট-ভিসায় ইতালির উদ্দেশে রওনা হন তিনি। কিন্তু ইতালি যাওয়া হয়নি তাঁর। দুবাই হয়ে লিবিয়ায় গিয়ে নামেন। ইতালিপ্রবাসী দালাল খোকন ওরফে সুমন মাতব্বর তাঁকে বলেন, এখন ইতালির সীমান্ত বন্ধ। কিছুদিন এখানেই থাকতে হবে। সীমান্ত খোলার পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হবে।

দালালের কথা বিশ্বাস করে লিবিয়ায় থাকতে শুরু করেন সিরাজুল। কিন্তু আট মাস পরও তাঁকে ইতালি নেওয়ার নাম নেই। ইতালি থেকে দালাল জানান, নৌপথে তাঁদের ইতালি নেওয়া হবে। অক্টোবরে দুই শতাধিক যাত্রী নিয়ে একটি নৌযান লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশে রওনা হয়, যার অন্যতম যাত্রী ছিলেন সিরাজুল।

নৌযানটি তিউনিশিয়ার উপকূলে ডুবে যায়। যাত্রীরা সাঁতরে তীরে উঠে প্রাণে রক্ষা পান। সিরাজুলের নতুন ঠিকানা তখন তিউনিশিয়া। তিনি এবার ইতালির কথা ভুলে দেশে ফিরে যেতে চান। দালাল খোকন এ ব্যাপারে অপারগতার কথা জানিয়ে ইতালি পৌঁছাতে আরো পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন। সিরাজুল ইতালি পৌঁছে টাকা দেবেন বলে জানালে দালাল খোকন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। তিউনিশিয়ায় দুই মাস অনাহারে-অর্ধাহারে কাটানোর পর প্রবাসী এক বাংলাদেশির সহযোগিতায় ২০২১ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরে আসেন সিরাজুল।

 

সিরাজুলের ভাষ্য, ওই সময় তাঁর মতো আরো ২০০ জনের   বেশি ব্যক্তিকে বিভিন্ন দেশে পাঠানোর কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে যান দালালরা। তাঁদের মধ্যে অনেকে দেশে আসতে পারলেও বেশির ভাগই পারেননি।

সিরাজুল ইসলামের তথ্যের সূত্র ধরে খোঁজ পাওয়া যায় মাদারীপুরের ডাসারের ছেলে আবু কালাম মাতুব্বরের। তিনিও দালালের খপ্পরে পড়ে ইতালির বদলে লিবিয়ায়  পৌঁছান।

 
আবু কালামের বাবা মোতালেব মাতুব্বর জানান, বাইরে যাওয়ার ছয় মাস পর্যন্ত ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এর পর থেকে আট মাস ধরে খোঁজ নেই তাঁর। শেষবার কালাম বলেছিলেন, ‘ইতালি যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কালকেই রওনা হব।’ এর পর থেকে নানাভাবে ছেলের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেও সফল হননি মোতালেব মাতুব্বর।

 

শুধু সিরাজুল ইসলাম বা আবু কালাম নন, এমন আরো অনেক ব্যক্তিকে এভাবে মোটা অঙ্কের টাকায় বিদেশ নিয়ে সঠিক গন্তব্যে না পাঠিয়ে ভুল ঠিকানায় নিয়ে প্রতারণা করা হচ্ছে। গৃহকর্মীর চাকরি দেওয়ার কথা বলে বিদেশ নিয়ে প্রতারণার অভিযোগও কম নয়। এ ক্ষেত্রে অনেক নারীকে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তাঁরা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। না পাচ্ছেন বেতন আর না পাচ্ছেন কোনো সুযোগ-সুবিধা। শুধু চলছে নির্যাতন।

সাবিহার (ছদ্মনাম) বাড়ি ঝিনাইদহের মহেশপুরে। গত বছরের আগস্ট মাসে গ্রামের এক দালালের মাধ্যমে গৃহকর্মীর ভিসায় তিনি ওমান যান। সেখানে এক বাসায় কাজ শুরু করলে মালিক তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে চান। তিনি বাধা দিলে জানতে পারেন, সেই বাসার মালিক তাঁকে উচ্চ মূল্যে কিনে নিয়েছেন। তাই তাঁর হুকুম অনুযায়ী চলতে হবে। সাবিহা পালানোর চেষ্টা করলে তাঁকে শিকল দিয়ে আটকে রাখা হয়। চলে যৌন নির্যাতনসহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এভাবে দুই মাস নির্যাতন ভোগ করার পর এক পর্যায়ে তিনি পালাতে সক্ষম হন।

ওমানের বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে থাকার পর সাবিহা প্রবাসী এক নারীর সহযোগিতায় এ বছরের জানুয়ারিতে দেশে ফিরতে পেরেছেন।

সাবিহার তথ্য অনুযায়ী, তাঁর সঙ্গে আরো ১১ জন নারী ওমান থেকে দেশে ফিরে আসেন। বিভিন্ন জেলা থেকে গিয়ে প্রতারিত হন তাঁরা।

জাতিসংঘের মানবপাচারবিষয়ক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে যেসব মানবপাচারের ঘটনা শনাক্ত হয়েছে, তার বেশির ভাগই ঘটেছে ঢাকা, খুলনা ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে। এ অঞ্চলগুলোর ঝিনাইদহ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, নড়াইল, শরীয়তপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জে সবচেয়ে বেশি মানবপাচারের ঘটনা ঘটে। এসব জেলা থেকে প্রতি লাখে দেড়জনের বেশি মানুষ পাচারের শিকার হয়।

ব্র্যাকের তথ্য মতে, ২০২২ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢুকেছেন ২২ হাজার ১০৫ বাংলাদেশি। ভূমধ্যসাগরে নৌযান দুর্ঘটনায় বছরে গড়ে ৫০০ বাংলাদেশির মৃত্যু ঘটে।

 
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মানবপাচার কমাতে হলে সমন্বয় প্রয়োজন। কিন্তু কোনো ধরনের সমন্বয় আমাদের মধ্যে নেই। পাশাপাশি এ বিষয়ে কোনো আলোচনাও নেই। যখন কোনো তথ্য বা খবর প্রকাশিত হয়, তখন সবাই এ নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু এটি জিরো টলারেন্সে আনার বিষয়ে কারো কোনো পদক্ষেপ  নেই। এদের আইনের আওতায় না নিয়ে এলে কখনোই মানবপাচার বন্ধ হবে না।’

 

সরকার সব ধরনের অবৈধ অভিবাসনকে নিরুৎসাহ করছে বলে জানান প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘সরকার সব ধরনের অবৈধ ও অনিয়মতান্ত্রিক অভিবাসনকে সব সময় নিরুৎসাহ করে। বিদেশে হয়রানির বিষয়ে শ্রম কল্যাণ শাখার মাধ্যমে প্রবাসী কর্মীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ অব্যাহত আছে।’

 

 

Brokers Reviled New Techniques for Human Trafficking